Dipika

Written by Dipika Deb Dipa

MA in Economics, Memorial University of Newfoundland.

Full Story here: https://www.facebook.com/notes/prospective-bangladeshi-students-in-canadian-universities/%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%A4%E0%A6%96%E0%A6%A8-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82%E0%A6%8F%E0%A6%96%E0%A6%A8/2260140527604521


©PBSCU This document is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-ShareAlike 4.0 Unported License. This license allows you to use, share and modify the document for noncommercial purposes only as long as it is redistributed under the same license and attribution to this work is made according to the license rules. We request that you cite the original writer’s name and the group’s name in all cases.



(১) মেয়েটি তখন বাংলাদেশেঃ প্রথমবার ভিসা রিজেকশন


গল্পের শুরু ২০১৩ সালে। আমি সবে মাত্র অর্থনীতিতে অনার্স শেষ করেছি। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি কানাডা পাড়ি জমাবে, মাস্টার্স করতে। সে আমাকে খুব করে বললো, দোস্ত তুই চেষ্টা কর, তোর হবে। আমার মাথায় তখন বিসিএস নাকি ব্যংক জব, এই চিন্তা। আমার ডাক্তার বরটি বরাবর ই আমাকে নিয়ে উচ্চাভিলাষী।সে অ বললো, শুরু করো তো খোজখবর নেওয়া, কেমনে কি করা যায়। তুমি বাইরে থেকে একটা ডিগ্রী করেই ফেলো।


তারপর শুরু হলো, অকুল পাথার সাঁতরানোর দিন। যাকেই বলি, সে বলে ইন্টারনেটে ই সব আছে। একে নক দেই, ওকে ফোন দেই কিন্তু কোথাও কোন সঠিক পথ আর পাই না। বন্ধুটিও বিদেশ গিয়ে হাজারো ঝামেলায় পড়ে আস্তে আস্তে কথা বলা কমে গেলো। একমাত্র তথ্য পাওয়ার জায়গা পেলাম, ফেসবুকে একটা গ্রুপ, PBSCU. https://www.facebook.com/groups/BSAAC সেখান থেকেই সবার পোস্ট, কমেন্ট দেখে পরবর্তি পদক্ষেপের ধারনা নিতাম। যেহেতু, বাইরে যাবো কি না তার কোন ঠিক ঠিকানা ছিলো না, তাই মাস্টার্স শুরু করে দিলাম। বুঝা গেলো, সবার আগে দরকার আইইএলটিএস এর ভালো স্কোর। মাস্টার্স আর আইইএলটিএস এর পড়া, পাশাপাশি একটা কলেজে পড়াতাম। জীবনখানা তেজপাতা হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিদিন নেট ঘেটে ইউনিভার্সিটি দেখতাম, তারপর ডিপার্টমেন্ট, প্রফেসর, মিনিমাম রিকুয়ারমেন্ট, ফান্ডিং এমাউন্ট, টিউশান ফিস, তারপর আবার অই শহরে থাকা-খাওয়ার খরচ কেমন কত কিছু যে দেখতাম !!! মাস্টার্স ১ম সেমিস্টার ফাইনাল দিয়েই প্রথমবার আইইএলটিএস দিলাম। মনে হলো ৬.৫ এর চেয়েও ভালো করতে পারবো। কিছুদিন পরে আবার দিলাম, এবার ৭.৫। এর মধ্যে আমার ইউনিভার্সিটি পছন্দ করা শেষ। যথাসময়ে ধুমধাম এপ্লাই করে দিলাম। এবার শুরু অপেক্ষার। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় কোন ইমেইল আর আসে না। আমি চরম হতাশায় প্রতিদিন সব ইউনিভার্সিটির একাউন্ট চেক করি, ইনবক্স এ কিছুই আসে না।


অবশেষে আসলো। প্রথম রিজেকশন। সব বন্ধু-বান্ধব বিসিএস আর ব্যাংক জবের পড়া পড়ছে আর আমার হাতে রিজেকশন লেটার। ১৫-২০ দিনের মধ্যে আরো ৩ টা ইমেইল আসলো এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে প্রতিটায় এডমিশন পেলাম, ২টা আবার ফুল ফাণ্ডিং।

কিন্তু ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্যারার নাম হলো, ভিসা। তাও এপ্লাই করবো বর সহ। কি লিখবো, কেমনে লিখবো, কি কি কাগজ দিবো-আবার উত্তর না জানা হাজারো প্রশ্ন এবং উত্তর পেলাম ‘PBSCU’ গ্রুপে। আমার সেশন জটে পড়ে মাস্টার্স ২য় সেমিস্টার সবে শুরু আর বর ৩৩তম বিসিএস দিয়ে সীমান্তবর্তি এলাকায় রুগী দেখতে ব্যস্ত। একজনের সময় হয়তো আরেকজনের হয় না, আমাদের সময় হয় তো অই অফিস আবার ঝামেলা হয়, সংসারের ঝামেলা কত কি !! তারপর আবার সিলেট থেকে ঢাকা যাওয়া, বিশাল ঝামেলার ব্যাপার। হাজারো ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে আবারো দুইজন টুকটুক করে এপ্লাই করেই ফেললাম। তারপর আবার অপেক্ষা।


তবে এই অপেক্ষা অত্যন্ত অসহ্য। দিন দুনিয়ার চৌদ্দ গুষ্টি জানে যে আমরা কানাডায় এপ্লাই করেছি। যার সাথে দেখা হচ্ছে, সে ই বলছে, কবে ‘বিদেশ’ যাচ্ছো? তোমরা তো বিদেশী, এই সেই সাত পাঁচ। আমার তখন ত্রাহি মধুসুদন অবস্থা। না ভিসার রেজাল্ট আসে, না দেশে কোন চাকরির প্রিপারেশন, সামনে আবার মাস্টার্স ২য় সেমিস্টার ফাইনাল। মাস তিনেক কাটার পরে গালে চপেটাঘাত করে এল দুইজনের ভিসা রিজেকশন লেটার। এবং কারনগুলো ছিলো, আমার নিজস্ব ইনকাম নেই, পাসপোর্টে বিদেশ ভ্রমন নেই, কান্ট্রি টাই নেই। মেজাজ তখন চরমে, বর তখন বললো, উহু এভাবে তো হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তুমি জিআরই দাও, একলাই যাবে। আমার মনে হলো, এই লোকের মাথায় সমস্যা আছে। এতগুলা টাকা, এত সময় নষ্ট হবার পর তার শখ আছে? সে আমাকে চরম বিস্মিত করে পরের দিন ই জিআরই র বই নিয়ে এলো এবং অত্যন্ত উতসাহে আমাকে অঙ্ক করাতে বসলো। বুঝতে পারলাম, আরো এক বছর অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াচ্ছি।


(২) মেয়েটি তখন বাংলাদেশেঃ এবার ভিসা হলো


বিয়ের ৬ বছরের মাথায় সে যখন আমাকে একা বাইরে পড়তে পাঠাতে পারে, তাও সমাজের প্রশ্নগুলো উপেক্ষা করে, তখন আমি কেন পারবো না একটু চেষ্টা করতে? ব্যাস, মাস্টার্স শেষ করলাম, নতুন জবে ঢুকলাম আর জিআরই প্রিপারেশন শুরু। কি যে অমানুষিক পরিশ্রম করতাম। সংসার, চাকরি, পড়াশোনা, আর সকলের হাজার প্রশ্ন, কেন ভিসা পেলাম না, কেন আবার চেষ্টা করছি, এবার না হলে কি করবো, বাইরে যাওয়া কেন এত জরুরি, তাও আবার একা, ব্লা ব্লা ব্লা।


একেকদিন মনে হত, বাদ দেই এসব ছাতা মাথা। ভালোই তো আছি এখানে। কিন্তু পড়ে যখন ভাবতাম এতকিছু কথা শুনেও যদি আমি সত্যি আকাশে উড়ি একদিন, তবে কেমন মজা হবে!!


এবার কাজ অনেক গুছানো ছিলো। ভুলগুলো জানতাম, পথগুলো জানতাম। এবার প্রফেসরকে মেইল করা, গ্রেড কো-অরডিনেটরকে মেইল করার ভাষা, সময়, নিয়ম জানতাম। খুব প্লান করে জিআরই তারিখ নিলাম। চাকুরির ও অনেক দিন হয়েছে। যথেষ্ট পরিশ্রান্ত আমি। যার ফলাফল জিআরই পরীক্ষা দিতে গিয়ে নার্ভাস ব্রেক ডাউন। সব প্যাঁচ গোচ লেগে বাজে অবস্থা। ২টা পার্ট দিয়ে মনে হলো একটা কিছু ক্লিক করে বের হয়ে যাই। কিন্তু সেই মুহুর্তে অত্যন্ত রোমান্টিকভাবে আমার বরের চেহারাটা সামনে ভেসে উঠলো। বেচারা জানি কড়া রোদের মধ্যেও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তার বউ যে পরীক্ষা দিচ্ছে। কোনমতে একখান স্কোর হলো, অই মুহুর্তে বসে তিনটা ইউনিভার্সিটিতে রেজাল্ট পাঠালাম। তারপর বিষন্ন বদনে বের হয়ে এলাম।


হাতে ভালো একটা আইইএলটিএস আর বাতিল জিআরই স্কোর নিয়ে আবার এপ্লাই করলাম ৩ টা ইউনিভার্সিটিতে। যদিও আগের বছরের ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন ডেফার করা আছে, তবুও ভালো কিছুর আশায়।


এবার আর নতুন ইউনিভার্সিটির রেজাল্টের অপেক্ষা না করে আগের বছরের ডেফারেল লেটার দিয়ে ভিসা আপ্লাই করতে গেলাম। শেষবার অকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি আসলে চাও আমি একাই যাই?ও বললো, হুম। অসম্ভব কঠিন একটা ডিসিশন ছিলো। ও নিতে পেরেছিলো বলে, আমিও ডিসিশান নিতে পেরেছিলাম।


এবার ভিসা এপ্লাই এর সময় একটা এক্সপ্লানেশন লেটার দিলাম, আগের বছরের রিজেকশন লেটার এর জন্য, এই এক বছরে কি কি করেছি। মনের ঝাল মিটিয়ে অই লেটারটা লিখেছিলাম। কেউ না কেউ তো পড়বে, মনে হচ্ছিলো তার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছি। এবার আমার জব আছে, ইনকাম আছে, যেহেতু আমার বাপ বেঁচে আছেন তাই আমার নিজের জায়গা জমি নাই, আর জামাই রেখে যাচ্ছি এর চেয়ে বড় কোন কান্ট্রি টাই নাই।


এবারের অপেক্ষাটা ভিন্ন ছিলো। ভিসা পেলে একা হয়ে সাবার থেকে। আর না পেলে বিসিএস। প্রতিদিন এমন ভাব করি যেন এসব কোন ব্যাপারই না কিন্তু মনে মনে অপেক্ষায় ফেটে যাচ্ছি।


অবশেষে, পেলাম আমি ইহাকে পেলাম !!!


আমি খুবই শক্ত ধাতের মেয়ে, সহজে কাঁদি না, কিন্তু সেদিন ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেছিলাম। ২০১৭ এর মে মাসে এসে ৪ বছরের অবর্ননীয় কষ্টের ফলস্বরুপ একখানা ইমেইল পেলাম। জীবন বদলে দেওয়া ইমেইল। এবার পাখি উড়াল দিবে আকাশে।


(৩) মেয়েটি এলো কানাডাঃ প্রথম বছর


২০১৬ তে ইউনিভার্সিটি অফ উইনিপেগে ফুল ফান্ডিং পেয়েছিলাম কিন্তু পরের বছর ভিসা এপ্লাই করার পর মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অফ নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে ফুল ফান্ডিং পেলাম, ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স। ডিএলআই নাম্বার চেঞ্জ করলাম, ব্যাস। বাংলাদেশ থেকে পরবর্তি গন্তব্য সেন্ট জন্স, নিউফাউন্ডল্যান্ড।


এবার জীবন নতুন কায়দায় প্যারা দেওয়া শুরু করলো। দেশ ছাড়ার আগে বরের সাথে সময় কাটাবো ভেবে ২ মাস আগেই চাকরী ছেড়ে দিলাম। পুরো সিনেমাটিক ভাবে, চাকরি ছাড়ার ৩ দিনের মধ্যে বরের ৩ মাসের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং এর ডাক এলো। বুঝে গেলাম, সবে মাত্র ট্রেইলার হলো, সামনের দিন আর খতরনাক হতে যাচ্ছে। কি নিব, কি না, বাসা ঠিক করা, কোর্স ঠিক করা, টাকা পয়সা কেমন নিব, ফ্লাইটে কি লাগে, ইমিগ্রেশনে কি জিজ্ঞেস করবে, খাওয়া কেমন হবে হাজার হাজার না উত্তর না জানা প্রশ্ন এনং উত্তর আবারো যথারীতি ‘PBSCU’। মেমোরিয়ালে আমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই পেলাম, উনি অনেক হেল্প করলেন। আমি সারাজীবনেও উনার সাহায্য ভুলবো না। আমার মেমোরিয়াল বা সেন্ট জন্স সম্পর্কে ধারনা ছিলো শুন্যের কোঠায়। উনি হেল্প না করলে আমি অই শুন্য ধারনা নিয়েই আসতাম।


বুকের মধ্যে অসম্ভব চাপ চাপ অনুভুতি আর মুখে হাসি নিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনের দরজার অপাশে আমার মা, বাবা, শশুড়, শাশুড়ি, বোন, বর- সমস্ত চেনা পৃথিবী রেখে অচেনা, অজানা শহরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।


জীবনে ২ লিটার পেপসির বোতল হাতে নিয়ে বাজারে হাঁটতে হয়নি, সেই আমি দুই দুইটা ধুমসো লাগেজ, পিঠে ভারী ব্যাকপ্যাক নিয়ে ট্রান্সিটে আবু ধাবি এয়ারপোর্টে দৌড়াচ্ছি। নিজেকে নায়িকা নায়িকা লাগছে, একটা মজা মজা ফিল হচ্ছে, সেই সাথে নিজেকে গাধাও লাগছে কারন কোন ধারনা ছাড়া দৌড়াচ্ছি, যদি পথ ভুল হয় তাইলে যে কোথায় যাবো তাও জানি না। নিজেকে বিস্মিত করে যথা সময়ে টরোন্টোর ফ্লাইটে উঠে গেলাম এবং জীবনের অসহ্যতম জার্নি শুরু করলাম। এক চেয়ারে টানা ১৪ ঘন্টা !!


টরোন্ট এসে টানা তিন ঘন্টা ইমিগ্রেশনের দাঁড়িয়ে আছি, আমার কানেক্টিং ফ্লাইট মিস। সামনে গিয়ে যে বলবো, তাও সাহস পাচ্ছি না। মনে হলো, মিস হলে মিস, আমার কোন কথাই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। যখন থেকে বাড়ির মানুষকে টাটা বলেছি এরপর কারো সাথে কথাই বলিনি। জীবনে এত সময় কখনোই চুপ থাকিনি। মনে হচ্ছিলো গলা দিয়ে আওয়াজ বের হবে না। অবশেষে হাতে সাদা কাগজে লাল-কালো মিশেলে লিখা ‘স্টাডি পারমিট’ পেলাম। টরোন্ট এয়ারপোর্টে মামা অপেক্ষা করছিলেম, উনার সাথে দেখা করলাম, কানেক্টিং ফ্লাইট পেলাম রাত ১ টায়।

আমার সবচেয়ে ভয় হচ্ছিলো এই জার্নিটাই। কেন জানি মনে হচ্ছিলো, আটলান্টিকে প্লেনটে ভেঙ্গে পড়ে যাবে। কোন খাওয়া ছাড়া, ঘুম ছাড়া, মোস্ট ইম্পর্টান্ট কথা ছাড়া এত ধকল গেছে যে, ফ্লাইটে উঠে চোখ খুলেই রাখতে পারছিলাম না। মনে হলো মরে গেলে তো এমনেও চিরিনিদ্রায়ই যাবো, সো এখন ভয় বাদ দিয়ে ঘুম দেই।


চোখ খুলে দেখলাম, আমাকে নামতে হবে, এসে গেছি সেন্ট জন্স। উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে। গুটিগুটি পায়ে নামলাম, ভাইয়া আর আপুকে দেখতে পেলাম। কি যে খুশী লাগছিলো এবং প্রথম ধাক্কা খেলাম, আমার লাগেজ আসেনি। ব্যাকপকে কাপড় ছিলো। ভাইয়াদের বাসায় খাবার খেয়ে রাত ৪:৩০ টায় নতুন ঠিকানায় এলাম। ঘুম দিলাম এবং পরের দিন কোন ধরনের জেট ল্যাগ ছাড়া ১০টায় ঘুম ভাঙ্গলো। আমার ঠিকানায় আমার লাগেজ দিয়ে গেলো। শুরু হলো নতুন জীবন।


কোন কিছু চিনি না। কিচ্ছু না। জীবনের সঙ্গী কফি, ইউটিউব, গুগল ম্যাপ আর ইন্টারনেট। গাধার মত রাস্তায় হাঁটি, এক পথে বারবার ঘুরি, গুগল ম্যাপ রিড করতে পারি না। বাসে উঠতে জানি না। রাস্তায় দাঁড়ায় দাঁড়ায় দেখি মানুষ কেমনে উঠে, বাসে উঠসি তো নামতে জানি না। খালি হাটতাম আর মানুষ দেখতাম। মানুষ কি করে, কেমনে করে, কেমনে বাসে কয়েন দিয়ে রাইড নেওয়া যায়, কেমনে কোন জিনিশের প্রাইস ট্যাগে ডলার কে টাকায় কনভার্ট করে জিনিশের দাম ঠিক করতে হয়। চারপাশে খালি ইংলিশ, তাও আইরিশ একসেন্ট। অর্ধেক বুঝি, অর্ধেক রাডারের বাইরে দিয়ে যায়। খুধা লাগলে কোন দোকানে গিয়ে যে খাবার কিনবো, তাও জানি না, কেমনে অর্ডার দেয়, কোন খাবারে কি থাকে। মনে আছে, গুগলে সার্চ দিয়েছিলাম, হাউ টু বাই উইন্টার বুট।


আর যা ই করতাম, বাসায় ছবি তুলে পাঠাতাম। মা এই দেখো, ফুল, ঘাস, লতা, পাতা, এই রান্না, খাবার, ইউনিভার্সিটি কত কি !!!

তবে এই শহরটা কেন জানি খুব আপন আপন লাগতো। সিলেটের মত লাগতো। উঁচু নিচু পাহাড়ী পাহাড়ী পথ, কেমন একটা আলসে আলসে ভাবে সকাল শুরু হয়, মানুষগুলো ও হাসি হাসি। মনে হত আমি তো হারানোই আছি আর কি হারাবো, আর কি পথ ভুলবো।

আস্তে আস্তে পথগুলো চিনতে লাগলাম, মানুষজনের সাথেও কেমন কেমন করে পরিচয় হয়ে গেলো। টুকটাক গান গাই, সেই সুবাদে অনেকের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো।


পড়াশোনার প্রচন্ড চাপ, ঠিকমত বাজার করার সময় পাই না, পরীক্ষার সময় কেক, বিস্কুটের উপর চলি। পার্টটাইম কাজ করি। মনঃ ভালো না লাগলে রাত বিরেতে হাঁটতে বের হয় যাই।


(৪) মেয়েটি এখন কানাডাঃ দ্বিতীয় বছর


কেমন কেমন করে যেন বছর ঘুরে গেছে। এখন অনেক কিছু চিনি। কোথায় কোন জিনিশটা ভালো পাওয়া যায়, কোন বাসে কোথায় যেতে হবে, দিনের শুরুতে অয়েদার রিপোর্ট দেখে বের হতে হবে বাসা থেকে (নিউফাউন্ডল্যান্ডে বলে, তোমার যদি আবহাওয়া পছন্দ না হয় তাহলে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করো। এখানে এত দ্রুত আবহাওয়া চেঞ্জ হয়)।


প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ ফেসবুকে নক দেয়, বাইরে আসতে চায়, কি করবে, কেমনে করবে। আমি চেষ্টা করি সাহায্য করার, যতটুকু সম্ভব।আমি চাই না আমার মত কেউ অকুল পাথারে পরুক।


এখানে সবাই ব্যাস্ত, কালে ভদ্রে কোন অনুষ্ঠান হলে সবাই ঝাপিয়ে পড়ে, আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জন্য। এখানে যেমন অমানুষিক পরিশ্রম আছে, তেমনি আছে খোলা বাতাসে নিশ্চিন্ত নিস্বাস নেবার প্রশান্তি। অসম্ভব সুন্দর প্রকৃতি আছে কিন্তু নেই পরিবারের মানুষগুলো। এখানে পড়াশোনায় কোন ফাকি চলে না, কিন্তু এখানকার মানুষের ভদ্রতা আপনাকে ভালোভাবে চলতে বাধ্য করবে।


এতদুর আসার পথ মোটেও সহজ ছিল না, এই যে আজ যে পর্যায়ে আছি সেটাও খুব ভালো নয়। যাবার আছে আরো অনেক পথ। জীবনে একটার পরে একটা চাওয়া আসতেই থাকে, আমরাও চেষ্টা করতে থাকি, আর একটার পর একটা মাইলফলক পাড়ি দেই। দিন শেষে সবাই অর্জন দেখে, কেউ জানে না, জানতে চায়ও না, কেমন ছিলো নির্ঘুম রাতগুলো, দুশ্চিন্তার প্রহরগুলো, বাস মিস করে আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে কুয়াসা ভেজা চোখ নিয়ে মেয়েটি কিভাবে বাসায় ফিরেছিলো। যারা আমরা বাইতে থাকি, আমরা চাই ও না, কেউ জানুক। সবাই চোখের নিচের কালি না দেখে, সাদা তুষারের সামনে লাল টুপি পড়া হাসিমুখের সেলফিটাই দেখুক।


লাল-সবুজের সীমানায় বসে যারা স্বপ্ন দেখছেন কানাডায় এসে পড়ার, তাদের স্বপ্ন পুরন হোক। আর যারা লাল-সাদার সীমানায় নতুন পথে চলার স্বপ্ন দেখছে, তাদের স্বপ্ন পুরন হোক। এর সবগুলো মুখ হোক হাসিমুখ।


Image Courtesy: https://www.westjetmagazine.com/story/article/things-to-do-in-st-johns-newfoundland-this-summer